ফিরোজা বেগম

সংক্ষিপ্ত জীবনী

১৯৩০ সালের ২৮ জুলাই ফরিদপুর শহরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের তৃতীয় কন্যারুপে জন্মগ্রহণ করেন নজরুল সংগীতের অবিস্মরণীয় শিল্পী ফিরোজা বেগম। প্রখ্যাত আইনজীবী খান বাহাদুর মোহাম্মদ ইসমাইল তাঁর পিতা এবং বেগম কাওকাবন্নেসা তাঁর মাতা।

মাত্র ১৩ বছর বয়সে চিত্ত রায়ের কাছে কলকাতায় তাঁর আনুষ্ঠানিক সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয়। এক বছর পরে ফিরোজা বেগম সংগীত শিক্ষা শুরু করেন তৎকালীন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কমল দাশগুপ্তের সরাসরি তত্ত্বাবধানে।মাত্র ১৪ বয়সে ফিরোজা বেগমের প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয় কলকাতার বিখ্যাত কলম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানী থেকে। তখন থেকেই কলকাতা বেতারকেন্দ্রে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশনা করতে থাকেন ফিরোজা বেগম। তখন তিনি ইসলামী সঙ্গীত , গীত, গজল, ভজন, আধুনিক বাংলা গান ও নজরুল সঙ্গীত অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিবেশন করেন। হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানী থেকে একের পর এক অনেকগুলি বাংলা ও হিন্দি/ উর্দু গানের গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হতে লাগলো ফিরোজা বেগমের। এর মধ্যে “আমার মনের সাগর কিনারে”, “কভু পাই কভু পাইনা”, “তুমি যদি চাহ মোরে”, “একটি হৃদয় গান গেয়ে যায়”, “তুম ভুলায়ে না গ্যয়ে”, “কিউ তুমসে মুঝকো প্যয়ার”, “ক্যব ত্যক ইয়ে পেরেশানী”, “ঠ্যাহরো ঠ্যাহরো জ্বারা” প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ফিরোজা বেগম কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিদ্ধে এসেছিলেন ওনার সঙ্গীত জীবনের শুরুতেই। বাংলা আধুনিক ও উর্দু গীতের এই সফল শিল্পী এই সময় নজরুল সঙ্গীতের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে অন্যান্য সব ধরনের গান পরিত্যাগ করে তিনি নজরুলের গানের প্রতি সম্পূর্ণ নিমগ্ন হয়ে গেলেন। নিরলস ও একাগ্র সাধনার মাধ্যমে তিনি আয়ত্ব করলেন এমন এক অনবদ্য গায়কী যা অতি সহজেই নজরুল সঙ্গীত কে সাধারন মানুষের হৃদয়ে পোঁছে দিলো। নজরুলের গানকে নিয়ে তাঁর এই একনিষ্ঠ সংগ্রামকে তিনি দিলেন এক আন্দোলনের মর্যাদা। অবহেলিত “নজরুলের আধুনিক গান” ও “নজরুল গীতি” প্রতিষ্ঠিত হলো নজরুল সঙ্গীতের মর্যাদায়। তিনি পরিচিত হলেন “বিদ্রোহী কবির বিদ্রোহী শিষ্যা” রূপে।

পশ্চিমবাংলার বহু শিল্পী কমল দাশগুপ্তের তত্ত্বাবধানে ও পরিচালনায় নজরুল এবং আধুনিক গান রেকর্ড করেছেন। নজরুল সঙ্গীতের পাশাপাশি কমল দাশগুপ্তের বহু আধুনিক গান ফিরোজা বেগমের গলায় বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়। ফিরোজা বেগমের গাওয়া এবং রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা সাত শতাধিক। তাঁর মধ্যে দীর্ঘবাদন রেকর্ডের সংখ্যা ৩৬টি। স্বাধীনতার কিছু পূর্বে ফিরোজা বেগম সপরিবারে দেশে ফিরে আসেন। পশ্চিমবঙ্গে রেকর্ডিং এর পাশাপাশি বহু একক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। কলকাতার মহাজাতি সদন ও রবিন্দ্র সদনে তাঁর একক সঙ্গীতানুষ্ঠানে সংখ্যা ১৫০টি। ১৯৮০-২০০০ সালে আমেরিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়াতে তিনশ’র বেশি একক লাইভ অনুষ্ঠান করেন।

১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে সরকার ফিরোজা বেগমকে “স্বাধীনতা পদক” পুরষ্কারে ভূষিত করেন। ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে “বঙ্গসম্মান” পুরস্কার প্রদান করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার সঙ্গীতে আজীবন অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৩ সালে ফিরোজা বেগমকে “মহাগুরু” উপাধিতে সম্মানিত করেন। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার (সঙ্গীতে) “বঙ্গ বিভূষণ” উপাধি অর্পণ করেন। এ-ছাড়াও তিনি অগণিত সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তাঁর সুদীর্ঘ ৭৪ বছরের সঙ্গীত জীবনে- যেমন নেতাজী সুভাষচন্দ্র সম্মাননা, সত্যজিৎ রায় এওয়ার্ড (১৯৯২), বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত ডি-লিট এওয়ার্ড, জাপানের বিখ্যাত রেকর্ডিং কোম্পানি CBS কতৃক “গোল্ডেন ডিস্ক” এওয়ার্ড (শিল্পীর গাওয়া “শাওন রাতে যদি” নজরুল সঙ্গীতটির দশ লক্ষ কপি একমাসে বিক্রী হবার উপলক্ষে প্রদত্ত)।

একজন সত্যিকারের শিল্পী পদক আর সম্মাননার মধ্যে তাঁর সংগ্রাম ও সাধনার সার্থকতা খুঁজে পাননা। তিনি মানুষের অন্তরে রাজত্ব করতে ভালবাসেন। কোটি কোটি শ্রোতার হৃদয়ে ফিরোজা বেগম ভালবাসার স্থায়ী ঠিকানা প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরে, এক নাগরিক অনুষ্ঠানে শিল্পীর গানের একজন একান্ত ভক্ত বলেছিলেন যে নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পরে মনে হয়েছিল যে ফিরোজা বেগমতো আছেন; আর ফিরোজা বেগমের মৃত্যুর পরে মনে হচ্ছে যে এবার সত্যি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যু হলো। এই জননন্দিত শিল্পীর ৮৮ বছরের প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্ত ছিলো সাধনা ও সংগ্রামের এক অবাক উপমান। কেবল নজরুল সঙ্গীতের সংগ্রহ, প্রচার ও পরিবেশনায় তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর জীবন এবং এর সাফল্য তিনি তাঁর জিবদ্দশাতেই প্রত্যক্ষ করে গেছেন। নিজেই হয়ে উঠেছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

২০১৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর তিনি সবাইকে অশ্রুসিক্ত করে চিরতরে বিদায় নিয়ে গেলেন এবং সেই সাথে নজরুল সঙ্গীতের এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়ের অবসান হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর একজন জাতীয় পর্যায়ের সুযোগ্য সঙ্গীত শিল্পীকে “ফিরোজা বেগম স্বর্ণপদক” প্রদান করে। সেই সাথে প্রতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের বি.এ. সম্মান পরিক্ষায় সর্বোচ্চ সিজিপিএ প্রাপ্ত একজন শিক্ষার্থীকে একটি স্বর্ণপদক (অন্যান্য পদকের ন্যায়) বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রদান করা হয়।

ফিরোজা বেগম আর্কাইভের মাধ্যমে তাঁর বেশীরভাগ গান দর্শকশ্রোতাদের জন্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষিত হলো যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর গানকে উপভোগ করতে পারেন। ফিরোজা বেগম ইউটিউব চ্যানেল এবং ওয়েবসাইট এ সকল সংগ্রহ সবার কাছে পৌঁছে দেয়া হলো। বাংলা সঙ্গীত জগতে ফিরোজা বেগম চিরদিন অমর হয়ে থাকবেন।